ফল হলো নিষিক্ত ও পরিপক্ব ডিম্বাধার। অন্য কথায় ফল বলতে আমরা বুঝি আম, জাম, পেয়ারা, কলা, পেঁপে, কাঁঠাল, আনারস, আপেল, আঙুর আর লেবু এবং কমলালেবুকে। কেননা, চোখের সামনে এদের প্রায় সব সময় দেখি, হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। এসব ফল দেশের প্রায় সব এলাকাতে জন্মে। এসব ফলকে তাই আমরা বলি প্রচলিত ফল। এসব ফলের বাইরেও অনেক ফল পাওয়া যায়। এসব ফলকে বলা হয় অপ্রচলিত বা স্বল্প পরিচিত ফল। অর্থাৎ এসব ফলের অস্তিত্ব আছে, খুঁজলে পাওয়া যায় কিন্তু যখন তখন চোখে পড়ে না, দেশের সব এলাকায় জন্মে না, গাছের দেখা মেলে খুব অল্প। চাহিদা কম, প্রাপ্যতা কম, এদের অনেকে বনেবাদাড়ে নিতান্ত অনাদরে অবহেলায় বেড়ে ওঠে। প্রগতির ধারায় কেউ এদের পরিকল্পনায় আনে না। চাষাবাদ দূরে থাক প্রয়োজনীয় খাবার কিংবা পানিও অনেকের ভাগ্যে জোটে না। কোনো কোনোটার ঔষধিগুণ ও মানুষের জন্য উপকারী নিরামক, ধাতব ও অত্যন্ত প্রাণ রাসায়নিক দ্রব্যাদিতে সমৃদ্ধ হলেও মানুষের রসনাকে তৃপ্ত করতে পারছে না। অতীতে ফলের সংখ্যা হয়তো আরও বেশি ছিল। নানা কারণে এবং আমাদের অসচেতনতায় সেসব ফলের অনেকই দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এরা দিন দিন বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে।
অনাদিকাল ধরে যেসব ফল এদেশে চাষ হয়ে আসছে সেগুলোই আমাদের দেশি ফল। এ পর্যন্ত এ দেশে মোট ১৩০টি দেশি ফলের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৬০টি বুনো ফল। তবে সেসব ফলও যথেষ্ট পুষ্টিসমৃদ্ধ ও সুস্বাদু। বাকি ৭০টি ফলের মধ্যে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, নারিকেল, লিচু, কুল, লেবু, আনারাস, কলা ও পেঁপে এ ১০টি এ দেশের প্রধান দেশি ফল।
দেশি ফল কোনোগুলো? এটা একটি বিতর্কিত প্রশ্ন বটে। সহজে উত্তর হলো যেসব ফলের উৎপত্তি ও চাষ এ দেশের ভূখণ্ডে বা এ অঞ্চলে সেসব ফলকে আমরা দেশি ফল বলতে পারি। তর্কটা সেখানেই, ফল তো দেশ চেনে না। তার উপযুক্ত জলবায়ু ও মাটি যেখানে সেখানে সে জন্মে থাকে। সে অর্থে যেসব ফলের উৎপত্তি আমাদের অঞ্চলে সেসব ফলের সংখ্যা খুবই কম। অধিকাংশ ফলই হাজার হাজার বছর আগে অন্যান্য দেশ থেকে এ দেশে এসে খাপ খাইয়ে নিয়েছে এবং কালক্রমে সেগুলো আমাদের ফলে পরিণত হয়েছে। সব বিদেশি ফল আবার এ দেশে ভালো ফল দেয় না। যেসব ফল অনায়াসে এ দেশে জন্মে ও ভালো ফলন দেয় সেসব ফলকে এখন আমরা দেশি ফল হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। দেশীয় এসব ফলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এসব ফল একরকম বিনা যত্নেই এ দেশের মাটিতে ভালো ফলে। সাধারণত এসব ফলের গাছের তেমন কোনো সার সেচ দেয়া হয় না। এ দেশের মাটি ও জলবায়ুতে খুব ভালোভাবে এসব ফলের গাছ মানিয়ে গেছে। ঝড়-বাতাস কিংবা বন্যা খরাও অনেক দেশি ফলের গাছকে সহজে মারতে পারে না। এ যে দেশি ফলের ব্যাপকভাবে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা বা ওয়াইড অ্যাডাপ্টিবিলিটি, তা কিন্তু অনেক বিদেশি ফলেরই নেই।
দেশি ফলের আর একটা সুবিধা হলো, বিদেশি ফলের বা উন্নত জাতের ফল গাছের মতো এসব ফল বা ফল গাছে অত বেশি রোগ পোকার আক্রমণ হয় না। তবে দেশি ফলে সবচেয়ে বেশি মেলে পুষ্টি। দেশি ফলের মতো এত বেশি পুষ্টি কখনও বিদেশি ফলে মেলে না। একটা ছোট্ট আমলকীতে যে পরিমাণ ভিটামিন সি আছে তা পাঁচটা বড় কমলাতে পাওয়া যাবে না। তাছাড়া আমাদের দেশে কলা, কুল, নারিকেল ছাড়া প্রায় সব ফলই জন্মে গ্রীষ্ম বর্ষার। কিন্তু দেশি অনেক ফল আছে যেগুলো অন্য মৌসুমেও জন্মে। তাই সারা বছর ধরেই বলতে গেলে ফল খাওয়ার একটা সুবিধা মেলে। শুধু পুষ্টি বা প্রাপ্যতার দিক দিয়ে নয়, এখন অনেক দেশি ফলের দাম বিদেশি ফলের চেয়ে কম নয়।
আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, লিচু, কলা, আনারস, পেঁপে, নারিকেল ও কুল এ ৯টি আমাদের দেশের প্রধান ও প্রচলিত দেশি ফল; এগুলোকে আমরা সবাই চিনি। অনেকেই হয়ত চিনি আরও কিছু অপ্রধান ও স্বল্প আকারে চাষকৃত ফল সফেদা, কামরাঙা, লটকন, আমড়া, বাতাবিলেবু, কদবেল, বেল, জলপাই, তাল, খেজুর, তেতুঁল, জাম, জামরুল, আমলকী, বাঙি, তরমুজ, পেয়ারা ফলকে। কিন্তু অনেকেই চিনি না লুকলুকি, ডেউয়া, ডেফল, করমচা, জংলিবাদাম, কাঠবাদাম, কাজুবাদাম, গোলাপজাম, তুঁত, তিনকরা, সাতকরা, আদা জামির, জামির, মনফল, অরবরই, আঁশফল, তারকা ফল, গাব, বিলাতি গাব, আতা, শরিফা, কাউফল, তৈকর, ডালিম, চালতা, ডুমুর, বৈঁচি, টকআতা, পানিফল, সিঙ্গাড়াফল, জিলাপিফল, পদ্মফল, মাখনা, রুটিফল, বকুল, ফলসা, চুকুর, পাদফল, চিকান, পানকি চুনকি, টুকটুকি বা টাকিটাকি, বিলিম্বি, ডালিম, ক্ষুদিজাম ফলকে। এ ফলগুলোর অধিকাংশই এখন বিপন্ন। বসতবাড়িতে দু-একটি গাছ রয়েছে, বনে জঙ্গলেও কিছু আছে। অথচ পুষ্টি মানে এমনকি স্বাদ বৈচিত্র্যে এসব ফলের কোনো তুলনা হয় না। কেননা এক এক ফলের স্বাদ ও পুষ্টিগুণ এবং ভেষজ মূল্য এক এক রকম। অথচ এক রকম অবহেলা করেই আমরা আমাদের এসব ফলকে হারাতে বসেছি। তবে আমাদের সৌভাগ্য যে, এখনও অল্প স্বল্প হলেও এর অনেক ফলই দেশের মাটিতে টিকে আছে। এরই মধ্যে অনেক দেশি ফলকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। তাই চাষের উদ্যোগ না নিলে বন থেকে বুনো ফল হিসেবেই হয়ত তা এদেশ থেকে অচিরেই হারিয়ে যাবে।
তবে এখন যেটা জরুরি এসব জার্মপ্লাজমকে দেশের মধ্যে টিকিয়ে রাখা। বিলুপ্ত হওয়ার আগেই পদক্ষেপ নেয়া দরকার। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্যানতত্ত্ব বিভাগে একটি ফলের জার্মপ্লাজম সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে, গবেষণাও চলছে সেখানে। ১৯৯১ সাল থেকে তরুণ মেধাবী ও বুদ্ধিদীপ্ত গবেষকদের নিরলস গবেষণার ফলে বিভিন্ন প্রজাতির ফলের জাত বের করা সম্ভব হয়েছে। এ জাতগুলোর মধ্যে আমের ২৫টি, পেয়ারার ১০টি, কুলের ৩টি, লেবুর ৪টি, জাম্বুরার ৫টি, লিচুর ৪টি, তেঁতুল ৩টি, কামরাঙা ৩টি, জলপাই, লটকন, আমলকী, ডুমুর, অরবরই, কদবেল, কাঁঠাল ও আমড়ার ১টি করে জাত, জামরুলের ৩টি ও সফেদার ৩টি জাত রয়েছে। এ জার্মপ্লাজম সেন্টার থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার চারা ১৯৯১ সাল থেকে VFFP CARE-SHABGE এর মাধ্যমে উত্তরবঙ্গে ৯৯৭টি মাতৃগাছের বাগান তৈরি করে দিয়েছে এবং ২০০২ সাল থেকে World Vision Bangladesh এর মাধ্যমে ৭৯৫টি মিশ্রফলের বাগান স্থাপন করেছে। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিশেষ করে YRFPProject-DAE, BRAC, PROSHIKA, CARITAS, BADC, DAE, CDCS, IDEA, CHEVRON, PARI, fh Bangldesh, NEElachol, Paragon group, MATI, CARE, FAO,UNDP I World Vision Bangladesh এর মাধ্যমে অসংখ্য বংশানুক্রমিক (PEDIGREE) মাতৃগাছ কৃষকের দোরগোড়ায় সম্প্রসারণ করে যাচ্ছে। বংশীয় মাতৃগাছের ক্ষেত্রে এ সেন্টারটি এদেশের মানুষের কাছে অতি পরিচিত, অনন্য।
বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টার, বাকৃবি, ময়মনসিংহ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অতিরিক্ত লবণাক্ত মাটি, পাহাড়ি এলাকায় অম্লীয় মাটি, মঙ্গা এলাকায় বেলে মাটি ও বন্যা কবলিত উর্বর বেলে দো-আঁশ মাটিতে জার্মপ্লাজম সেন্টার কর্তৃক মুক্তায়িত ফলের অভিযোজন যাচাইয়ের ওপর গবেষণা করেছে। এ গবেষণাটি ড্যানিডার অর্থায়নে বাউ-জার্মপ্লাজম সেন্টার কর্তৃক উদ্ভাবিত ১৬টি জাতের দেশের দক্ষিণাঞ্চলে, উত্তরাঞ্চলে এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ৮টি জেলার ১৫টি উপজেলার প্রত্যেকটিতে ৩০ শতাংশ জমির ওপর ১২৯৬০টি চারার সমন্বয়ে ৬০টি মিশ্রফল বাগান তৈরি ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এডাপটেশন ট্রায়াল করা হয়, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটেও গবেষণা চলছে। এ ইনস্টিটিউটেও ফলের বিভিন্ন প্রজাতির ফলের জাত নিবন্ধন করেছে। এ জাতগুলোর মধ্যে আমের ১৫টি, কাঁঠাল ৩টি, কলা ৪টি, পেঁপে ১টি, পেয়ারা ২টি, বাতাবিলেবু ৩টি, লেবু ২টি, নারিকেল ২টি, আমড়া ১টি, আমলকী ১টি, বিলাতি গাব ১টি, সফেদা ৩টি, কুলের ৪টি, কামরাঙা ২টি, তেঁতুল ১টি, লিচু ৫টি, জামরুল ২টি, জলপাই, কদবেল, বেলের ১টি করে জাত। এসব জাতগুলো বিভিন্ন বেসরকারি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্প্রসারণ হয়ে আসছে।
সরকারও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব ফলকে জনপ্রিয় ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর জাতীয় পর্যায়ে ফল প্রদর্শনীর আয়োজন করছেন। দেশের প্রতিটি বাড়িতে এ বৃক্ষরোপণ মৌসুমে বিলুপ্ত প্রায় অপ্রচলিত ফলের অন্তত একটি চারা রোপণ করা উচিত বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। তা হলে হয়তো খুব অল্প সময়েই জেগে উঠতে পারে হারানো ফলের হারানো রাজ্য, বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে অনেক ফল প্রজাতি। তবে তার আগে যেটা দরকার সেটা হল বিলুপ্ত প্রায় ফলগুলো চিহ্নিত করা এবং এগুলোর ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করা, যেগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পথে সেগুলো রক্ষা করার চেষ্টা করা। আর যেগুলো অবাঞ্ছিত হয়ে পড়ে আছে তাদের উপড়ে তোলার পথ খোঁজা।
শুধু সরকার দেশি ফল প্রসারের ক্ষেত্রে ভূমিকা নিলে তা পরিপূর্ণ হবে না, এজন্যই দরকার দেশের সব জনগণের সম্মিলিত কার্যকর অংশগ্রহণ। প্রয়োজন ও প্রাপ্তির ব্যবধানের কারণ একদিকে যেমন সচেতনতার অভাব অন্যদিকে রয়েছে উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা। তাই দেশের খাদ্যপুষ্টির চাহিদা পূরণসহ আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে দেশি ফলের উৎপাদন ও ব্যবহার অনস্বীকার্য। সুতরাং স্বাদে, গন্ধে, পুষ্টিতে শ্রেয়তর আমাদের বর্ণিল দেশীয় ফলগুলোর উৎপাদন দেশব্যাপী সারা বছর বাড়িয়ে তুলতে হবে। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রয়োজন উপযুক্ত সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থাপনা। এতে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ পরিসরে গড়ে উঠবে আরও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প। ফলে কৃষিনির্ভর অর্থনীতি হবে আরও মজবুত ও গতিশীল, দেশবাসী পাবে খাদ্যে পুষ্টিমানসম্পন্ন একটি ভবিষ্যৎ।
প্রফেসর ড. এম. এ. রহিম*
ড. মো. শামছুল আলম (মিঠু)**
*উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ ও পরিচালক, জার্মপ্লাজম সেন্টার, বাকৃবি; **সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার, উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, বিনা, ময়মনসিংহ